নারায়ণগঞ্জ টুয়েন্টিফোর ডটকম:
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত হত্যাকান্ডের চার বছর পূর্ণ হলো আজ। গত এক বছর আগে উচ্চ আদালত এই মামলার রায় প্রদান হলেও এখনো তা কার্যকর না হওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন নিহতদের স্বজনরা। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন অধিকাশ পরিবারগুলো। সরকারের কাছে তাদের একটাই দাবী, উচ্চ আদালতের রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। হত্যাকান্ডের পর এই দীর্ঘ চার বছরে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছেন নিহত সাত পরিবারের স্বজনরা।
নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের সাড়ে চার বছরের কন্যা রোজা, দিনের অধিকাংশ সময় খুঁজে বেড়ায় তার বাবাকে। জন্মের আগেই বাবাকে হারানো এই অবুঝ শিশুটি অপেক্ষায় আছে তার বাবাকে দেখবে বলে। চাচা মো: সাজু কেই বাবা বলে ডাকে। শিশুটির সব আবদার চাচা পূরণ করলেও বাবার অভাব কেউ পূরণ করতে পারবে না বলে মনে করেন নিহত জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই সাজু। বাসার সামনে ছোট্ট একটা ওয়েল্ডিং কারখানার আয়ের উপর চলে তার ভাই, মা ও নিজের সংসার। কারখানায় কোন কর্মচারী নেই। রোদে পুঁড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নিজেই কাজ করেন। জাহাঙ্গীরের বিথবা স্ত্রী নূপুর শিশু সন্তানটিকে দাদীর কাছে রেখে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নি¤œ বেতনের চাকুরি করে সিদ্ধিরগঞ্জে সিটি করপোরেশনের কার্য্যালয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে দেয়া সহযোগিতার ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হলেও পরবর্তীতে কেউ খোঁজ না নেয়ায় অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় দিন কাটছে অধিকাংশ পরিবারের স্বজনদের। নানা ক্ষোভের মধ্য দিয়েও তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন রায় কার্যকরের সেই কাঙ্খিত দিনটির।
জাহাঙ্গীরের ভাই সাজু বলেন, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ভাইকে হারিয়ে আমরা চরম অর্থকষ্টে দিনযাপন করছি। ভাইয়ের এতিম মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করাই আমার একমাত্র চিন্তা। সরকার যদি মেয়েটির একটা দায়িত্ত নিতো তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আমি আমার ভাইকে হারিয়ে একই রকম ভাবে স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর অন্যান্য পরিবারগুলো।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুপুর বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই এ সরকারের আমলেই সাত খুনের মামলা আসামীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। যারা আমার স্বামীসহ সাতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।
নজরুলের বন্ধু নিহত স্বপনের ভাই রিপন বলেন, সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে যা ভেবেছিলাম বাস্তবে আমরা হতাশ হয়েছি। কারো কাছ থেকেই কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। রায় কার্যকরের ব্যাপারে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এই রায় নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তা এবং অন্ধকারের মধ্যে আছি। আদৌ কি এই রায় কার্যকর হবে ? নাকি এইভাবেই আমরা অন্ধকারের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকব? তিনি বলেন, ভাইকে হত্যার পর ভাইয়ের এবং আমার নিজের ব্যবসা বানিজ্য সব জোর করে দখল করে নিয়েছে নূর হোসেন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। নিজে এখন ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরণের হুমকি ধামকি। সব সময় একটা ভয়র মধ্যে থাকি, কোন দিন যেন আমাদেরকেও মেরে ফেলে।
স্বপনের খুনের খবর শুনে অন্ধ হয়ে যান তার বৃদ্ধ বাবা। চোখে কিছুউ দেখেন না। কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে ছেলের খুনীদেও বিচার দেথে যেতে পারলে আত্মায় শান্তি নিয়ে মরতে পারব। ছেলের আত্মাও শান্তি পাবে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।
নিহত তাজুল ইসলামের পিতা আবুল খায়ের বলেন, সাত খুন মামলার চার বছর শেষ হয়েছে। এ চার বছরে হাইকোর্ট পর্যন্ত এ মামলার রায়টি শেষ হয়েছে। এ রায় এখন সুপ্রীমকোর্টে গিয়েছে। আমরা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছি তাদের ফাঁসির রায় হয়েছে তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে, যাদের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে তাদের যাবজ্জীবন সাজা হবে। সরকার দলীয় কিছু লোক ও সরকারের কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা যারা সাধারণ মানুষকে নিরপত্তা দিবে, আর সেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ৭ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে ইট বেধে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে। এ নির্মম নির্যাতনের বিচার কি এ দেশে হবে না, আশা করি এ দেশেই হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই মনমানসিকতা আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। এ মামলায় যে কয়জন আসামী এখনও পলাতক রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানাই।
উচ্চ আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও রায় কার্যকরের ব্যাপারটি বিলম্ব হওয়ায় সংশয় প্রকাশ করেন মামলার বাদি নিহত নজরুল ইসলামের সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন এই হত্যাকান্ডের বিচার করবেন। তিনি তার কথা রেখেছেন। তাঁর উপর আমরা কৃতজ্ঞ। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট আছি। তিন্তু রায়টি কার্যকর কবে হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের মধ্যে আছি। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উচ্চ আদালতের এই রায় কার্যকরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবী জানান তিনি। #